Home > Work > বাঙালী জীবনে রমণী

বাঙালী জীবনে রমণী QUOTES

1 " চতুর্থ ঘটনা ১৯২৭ সনের। তখন আমি বেলেঘাটার কাছে শুঁড়ােতে থাকি। ফাঁড়িপথে কলিকাতা আসিবার জন্য একটা পায়ে চলার রাস্তা নারিকেলডাঙ্গার রেলপুল পর্যন্ত ছিল। সেটা ধরিয়া হ্যারিসন রােডের দিকে আসিতেছি। জায়গাটা ফাঁকা, কিন্তু মাঝে মধ্যবিত্ত গৃহস্থের একতলা কতকগুলি বাড়ী ছিল। পাড়াটার সামনে একটা মাঠের ধারে আসিয়াই দেখি ওপারে একটা ছােট রকমের ভিড়, উহাতে পুরুষস্ত্রীলােক দুইই আছে। কাছে গিয়া দেখিলাম একটি বাড়ীর সদরের কাছে একটি কিশােরী কাঁদ-কাঁদ মুখে দাঁড়াইয়া আছে। তাহার সামনে একটি স্থূলকায় ভদ্রলােক হেঁটো ধুতি পরিয়া খালি গায়ে চীৎকার করিতেছেন। পাশে একদিকে কয়েকটি প্রৌঢ়া গৃহিণী। এক গৃহিণীর মুখে শুনিতে পাইলাম, “ও মাগাে, কি ঘেন্নার কথা! সােমত্ত মেয়ের বুকে হাত দেয়া!"

ভদ্রলােকটির সামনে একটি যুবক অসহায়ভাবে জোড়হাতে দাঁড়াইয়া ছিল। সে গঞ্জনার উত্তরে অতি কাতরকণ্ঠে বলিল, “আমাকে আপনারা ভুল বুঝবেন না। আমি নিজের বােন ভেবে শুধু বোঁটাতে একটু কুরকুরুনী দিয়েছিলাম।”

ভদ্রলােকটি একেবারে বােমার মত ফাটিয়া গিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, “শালা! তুমি বােন ভেবে কুরকুরুনী দিয়েছিলে? কুরকুরুনী ঢুকিয়ে দেবাে তােমার পোঁদে!”

আমি তখন মূল ফরাসীতে কাসানােভার আত্মজীবনী পড়িতেছি। ভাবিলাম ইহা কি কাসানােভার অনুসন্ধান, না অন্য কিছু? যথেষ্ট আদিরসাত্মক বই পড়িয়াছিলাম, তাই প্রশ্ন করিলাম-ইহাও কি আদিরস? "

Nirad C. Chaudhuri , বাঙালী জীবনে রমণী

2 " এই পণ্ডিতেরা দুই উদ্দেশ্যে আদিরসাত্মক কাব্যের ব্যাখ্যা করিতেন। প্রথমত, প্রৌঢ় বয়সে যুবতী স্ত্রীর অনুগ্রহ পাইবার জন্য। ভূঁড়ি, ঊর্ধ্বগামী ও অধােগামী নানাপ্রকার দুর্গন্ধ ইত্যাদির দ্বারা পত্নীকে প্রতিকূল করিয়া কামপ্রবৃত্তির সাহায্যে অনুকূল করিবার জন্য আদিরসাত্মক কবিতার সহায়তা লইতেন। বঙ্কিমচন্দ্র ইহা জানিতেন। তাই তিনি শান্তি সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, পণ্ডিত “শান্তির অভিনব যৌবন বিকাশজনিত লাবণ্যে মুগ্ধ হইয়া ইন্দ্রিয় কর্তৃক পুনর্বার নিপীড়িত হইতে লাগিলেন। শিষ্যাকে আদিরসাশিত কাব্য সকল পড়াইতে লাগিলেন, আদিরসাশ্রিত কবিতাগুলির অশ্রাব্য ব্যাখ্যা শুনাইতে লাগিলেন। তাহাতে শান্তির কিছু অপকার না হইয়া উপকার হইল। লজ্জা কাহাকে বলে, শান্তি শিখে নাই; এখন স্ত্রীস্বভাবসুলভ লজ্জা আসিয়া আপনি উপস্থিত হইল।”

পণ্ডিতদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, প্রকাশ্যে ছাত্রদের সঙ্গে বদরসিকতা করা - কোনও সময়ে প্রচ্ছন্নভাবে, কোনও সময়ে খােলাখুলি। ছাত্রেরা অধ্যাপকের উক্তি মাথা নীচু করিয়া শ্রদ্ধাসহকারে শুনিত। কিন্তু পরে নিজেদের কথাবার্তায় উহার উপর বেশ করিয়া নিজস্ব রং চড়াইত। একটু চাপা ভাবে এই উৎপাত আমাদের ছাত্রাবস্থাতেও কিছু কিছু ছিল। আশ্চর্যের কথা এই, রাগিলেও পণ্ডিত মহাশয়েরা এই অধঃপতিত কাম হইতেই ভৎসনার পারিপাট্য সাধন করিতেন। কলিকাতার এক পণ্ডিত মহাশয় রাগিলেই বলিতেন, “তাে ছোঁড়াদের যা অবস্থা তাতে তাে বিছানার চাদর কেচে জল খাইয়ে দিলে ছুঁড়ীদের পেট হয়ে যাবে।” ছাত্রেরাও অবশ্য যতটুকু পারে টেক্কা দিতে চেষ্টা করিত। একদিন এক পণ্ডিত মহাশয় গরমে অস্থির হইয়া পাঙ্খাটানাওয়ালাকে বলিয়াছিলেন, “খেঁচো!” ক্লাসসুদ্ধ ছাত্র উহা হিন্দী অর্থে না লইয়া কলিকাতার বাংলা সমাজে প্রচলিত বাংলা অর্থে নিয়া উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিয়াছিল। "

Nirad C. Chaudhuri , বাঙালী জীবনে রমণী

3 " কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে কি, যাহা মনকে অভিভূত করিবার মত? আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ধারণা বিলাতের কল্পনায় করিতাম, একমাত্র সেখানকার দৃশ্যকে প্রাকৃতিক। সৌন্দর্য বলিয়া ধরিতাম, আমারও সেই মনােভাব ছিল। তাই ডি নদী ও মালভার্ন পাহাড়ের কথা মনে করিয়া যত আনন্দ পাইতাম, দেশের কথা মনে করিয়া তত আনন্দ পাইতাম না--অনন্ত মনকে বলিতাম না যে আনন্দ পাইতেছি। এই মনােবৃত্তির বশীভূত হইয়া “Banks and bracs o' bonie Doon" "O Brignal banks are wild and fair", "My heart is in the Highlands, my heart is not here" এই সব উচ্ছ্বাসের সহিত আবৃত্তি করিতাম। তখন আমি ক্লাস এইট-এ পড়ি এবং বেলেঘাটা-বালিগঞ্জ লাইনে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। পাঠ্য বইটা খুলিয়া শেষােক্ত কবিতাটি দেখিয়া থাকিতে পারিলাম না, উচ্চৈঃস্বরে পড়িয়া উঠিলাম। সামনে একটি ভদ্রলােক বসিয়াছিলেন, তিনি বিরক্ত হইয়া একেবারে। চেঁচাইয়া উঠিলেন, “য্যা য্যা, অত চাড় দেখাতে হবে না! ছেলে বাঁচলে হয়!”

বিদেশের সৌন্দর্য সম্বন্ধে এই মনােবৃত্তির বশেই ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ভাবিলেও আমরা সুদূর কাশ্মীর, হিমালয়, পুরী বা ওয়ালটেয়ারের সমুদ্রতীরের কথা স্মরণ করিতাম। বাংলাদেশের কথা মনেই পড়িত না। তবু আমার মনের গভীরতম তলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা তীব্র অনুভূতি ছিল। বিরাট নদী, ঢেউখেলানাে ধানের ক্ষেত, দিকচক্রবাল পর্যন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখিলে মনে কোনও ভাব বা ধারণা আসিত না, শুধু শরীর-মন দিয়া উহার সঙ্গে মিশিয়া যাইতাম। কিন্তু এই দৈহিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গত অনুভূতির পিছনে কোন বিচার ছিল না। তাই আমার এই তন্ময়তাকে কখনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি বলি নাই—অবশ্য অল্পবয়সে।

বড় হইয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম, সত্যই কি বাংলাদেশের কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আছে? একদিন বিকালে বেড়াইবার সময়ে কিশােরগঞ্জ শহর হইতে রেল লাইন ধরিয়া মাইল। কয়েক উত্তর দিকে যাইবার পর একটা জলে ডােবা ধানক্ষেতের ওধারে একটি বাস্তুভিটা দেখিতে পাইলাম। মাঝখানে একটা পুকুর। তাহার উঁচু পাড়ের উপর ছয়-সাতটা আটচালা। উল্টাদিকে বাঁশের ঝাড়। স্থির নিস্তরঙ্গ জলে আটচালার স্পষ্ট ছায়ার সম্মুখে নীল আকাশ ও সন্ধ্যার রক্তিম মেঘের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। সমস্তটা কনস্টেবলের ছবির মত। তখনই বুঝিলাম, বাংলাদেশেরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। উহার দিকে মুখ ফিরাইয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিতে হইবে। এই নূতন দৃষ্টি ফিল্মস্টারের রূপ হইতে চোখ ফিরাইয়া ঘরের মেয়ের রূপ দেখিবার মত। "

Nirad C. Chaudhuri , বাঙালী জীবনে রমণী

4 " ইহার পর সংবাদপত্রে ব্যক্তিগত আক্রমণের কথা বলিব। আমি এই ধরনের আক্রমণ কিছু পড়িয়াছি। উহা যে অতি জঘন্য স্তরের হইত সে বিষয়ে সন্দেহ করা চলে না। ইহার আভাস দিতেছি। একটি পত্রিকায় পাঁচী-নাম্নী ঝির স্বাক্ষরিত একটি পত্র ছাপা দেখিয়াছি। উহাতে বাড়ীর গৃহিণীর সহিত চাকরের দুপুরবেলাকার ব্যাপারের বর্ণনা দেওয়া হইয়াছিল, এবং বলা হইয়াছিল যে, উহা এই পরিচারিকার চাক্ষুষ দেখা। এই ঘটনাটা কলিকাতার একজন ভদ্রগৃহস্থের বাড়ীতে ঘটিয়াছে, ইহাও নাম করিয়া বলা হইয়াছিল।

কবিদের ঈর্ষাপ্রসূত আড়াআড়িতে এই ধরনের নিন্দা আরও কুৎসিত ভাবে করা হইত। আমি পড়িয়াছি এরূপ একটিমাত্র দৃষ্টান্ত দিতেছি। এক কবি অন্য কবির মাতা সম্বন্ধে বলিতেছেন যে মাতা পুত্রবধূর সহিত (অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী কবির স্ত্রীর সহিত) অস্বাভাবিক ভাবে কাম পরিতৃপ্ত করিতেছে। ইহার খােলস বর্ণনা আছে। পুত্রবধূ হতভম্ব হইয়া, “শাশুড়ী কি কর, কি কর,” বলিয়া চেঁচাইতেছে, কিন্তু শ্বশ্রুমাতা কিছুমাত্র গ্রাহ্য না করিয়া কাজ সমাধা করিতেছে, ও এই কাজের কি সুখ তাহা পুত্রবধূকে বুঝাইতেছে। ইংরেজী ভাষায় ও অন্যান্য ইউরােপীয় ভাষায় এই কাজের সূচক যে শব্দ আছে, তাহার অন্তত ভাষাগত ভদ্রতা আছে। কিন্তু এই বিবরণ হইতে প্রথম জানিলাম, ইহার জন্য বাংলা ভাষায় অতি ইতর একটা কথা প্রচলিত ছিল। এই সব কাহিনী প্রমাণ হিসাবে নিলে বহু ছাঁটিয়া নিতে হইবে। "

Nirad C. Chaudhuri , বাঙালী জীবনে রমণী

5 " পরবর্তী যুগে হিন্দু সতীত্ব ও পাতিব্ৰত্য লইয়া বহু আলােচনা হইয়াছিল, উহার বড়াইও কম হয় নাই। কিন্তু পুরাতন রচনায় ইহার কোনও আলােচনা নাই, উল্লেখও অত্যন্ত কম। গার্হস্থ্যজীবনে স্ত্রীলােকের সতীত্ব ও পাতিব্ৰত্য এ-রকম একটা মামুলী আচরণ বলিয়া ধরা হইত যে, উহা নরনারীর সম্পর্কিত ‘আইডিওলজি’র অন্তর্ভুক্তই হয় নাই। পাশ্চাত্ত্য প্রভাব আসিবার পর এই প্রাচীন হিন্দু ধারণাকে পাশ্চাত্ত্য প্রেমের 'অ্যান্টিথিসিস' হিসাবে দাঁড় করানাে হইয়াছিল। কামই যে নরনারীর সম্পর্কের মূল কথা ইহার বিরুদ্ধে আপত্তি ভােলা পূর্বযুগে আবশ্যক মনে হয় নাই। বরঞ্চ স্বাভাবিক বলিয়া মানিয়া শুধু একটু মশলাদার করিয়া পরিবেশন করা হইত। "

Nirad C. Chaudhuri , বাঙালী জীবনে রমণী