বিদেশের সৌন্দর্য সম্বন্ধে এই মনােবৃত্তির বশেই ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ভাবিলেও আমরা সুদূর কাশ্মীর, হিমালয়, পুরী বা ওয়ালটেয়ারের সমুদ্রতীরের কথা স্মরণ করিতাম। বাংলাদেশের কথা মনেই পড়িত না। তবু আমার মনের গভীরতম তলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা তীব্র অনুভূতি ছিল। বিরাট নদী, ঢেউখেলানাে ধানের ক্ষেত, দিকচক্রবাল পর্যন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখিলে মনে কোনও ভাব বা ধারণা আসিত না, শুধু শরীর-মন দিয়া উহার সঙ্গে মিশিয়া যাইতাম। কিন্তু এই দৈহিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গত অনুভূতির পিছনে কোন বিচার ছিল না। তাই আমার এই তন্ময়তাকে কখনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি বলি নাই—অবশ্য অল্পবয়সে।

বড় হইয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম, সত্যই কি বাংলাদেশের কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আছে? একদিন বিকালে বেড়াইবার সময়ে কিশােরগঞ্জ শহর হইতে রেল লাইন ধরিয়া মাইল। কয়েক উত্তর দিকে যাইবার পর একটা জলে ডােবা ধানক্ষেতের ওধারে একটি বাস্তুভিটা দেখিতে পাইলাম। মাঝখানে একটা পুকুর। তাহার উঁচু পাড়ের উপর ছয়-সাতটা আটচালা। উল্টাদিকে বাঁশের ঝাড়। স্থির নিস্তরঙ্গ জলে আটচালার স্পষ্ট ছায়ার সম্মুখে নীল আকাশ ও সন্ধ্যার রক্তিম মেঘের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। সমস্তটা কনস্টেবলের ছবির মত। তখনই বুঝিলাম, বাংলাদেশেরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। উহার দিকে মুখ ফিরাইয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিতে হইবে। এই নূতন দৃষ্টি ফিল্মস্টারের রূপ হইতে চোখ ফিরাইয়া ঘরের মেয়ের রূপ দেখিবার মত।"/>

Home > Author > Nirad C. Chaudhuri >

" কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে কি, যাহা মনকে অভিভূত করিবার মত? আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ধারণা বিলাতের কল্পনায় করিতাম, একমাত্র সেখানকার দৃশ্যকে প্রাকৃতিক। সৌন্দর্য বলিয়া ধরিতাম, আমারও সেই মনােভাব ছিল। তাই ডি নদী ও মালভার্ন পাহাড়ের কথা মনে করিয়া যত আনন্দ পাইতাম, দেশের কথা মনে করিয়া তত আনন্দ পাইতাম না--অনন্ত মনকে বলিতাম না যে আনন্দ পাইতেছি। এই মনােবৃত্তির বশীভূত হইয়া “Banks and bracs o' bonie Doon" "O Brignal banks are wild and fair", "My heart is in the Highlands, my heart is not here" এই সব উচ্ছ্বাসের সহিত আবৃত্তি করিতাম। তখন আমি ক্লাস এইট-এ পড়ি এবং বেলেঘাটা-বালিগঞ্জ লাইনে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। পাঠ্য বইটা খুলিয়া শেষােক্ত কবিতাটি দেখিয়া থাকিতে পারিলাম না, উচ্চৈঃস্বরে পড়িয়া উঠিলাম। সামনে একটি ভদ্রলােক বসিয়াছিলেন, তিনি বিরক্ত হইয়া একেবারে। চেঁচাইয়া উঠিলেন, “য্যা য্যা, অত চাড় দেখাতে হবে না! ছেলে বাঁচলে হয়!”

বিদেশের সৌন্দর্য সম্বন্ধে এই মনােবৃত্তির বশেই ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ভাবিলেও আমরা সুদূর কাশ্মীর, হিমালয়, পুরী বা ওয়ালটেয়ারের সমুদ্রতীরের কথা স্মরণ করিতাম। বাংলাদেশের কথা মনেই পড়িত না। তবু আমার মনের গভীরতম তলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা তীব্র অনুভূতি ছিল। বিরাট নদী, ঢেউখেলানাে ধানের ক্ষেত, দিকচক্রবাল পর্যন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখিলে মনে কোনও ভাব বা ধারণা আসিত না, শুধু শরীর-মন দিয়া উহার সঙ্গে মিশিয়া যাইতাম। কিন্তু এই দৈহিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গত অনুভূতির পিছনে কোন বিচার ছিল না। তাই আমার এই তন্ময়তাকে কখনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি বলি নাই—অবশ্য অল্পবয়সে।

বড় হইয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম, সত্যই কি বাংলাদেশের কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আছে? একদিন বিকালে বেড়াইবার সময়ে কিশােরগঞ্জ শহর হইতে রেল লাইন ধরিয়া মাইল। কয়েক উত্তর দিকে যাইবার পর একটা জলে ডােবা ধানক্ষেতের ওধারে একটি বাস্তুভিটা দেখিতে পাইলাম। মাঝখানে একটা পুকুর। তাহার উঁচু পাড়ের উপর ছয়-সাতটা আটচালা। উল্টাদিকে বাঁশের ঝাড়। স্থির নিস্তরঙ্গ জলে আটচালার স্পষ্ট ছায়ার সম্মুখে নীল আকাশ ও সন্ধ্যার রক্তিম মেঘের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। সমস্তটা কনস্টেবলের ছবির মত। তখনই বুঝিলাম, বাংলাদেশেরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। উহার দিকে মুখ ফিরাইয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিতে হইবে। এই নূতন দৃষ্টি ফিল্মস্টারের রূপ হইতে চোখ ফিরাইয়া ঘরের মেয়ের রূপ দেখিবার মত। "

Nirad C. Chaudhuri , বাঙালী জীবনে রমণী


Image for Quotes

Nirad C. Chaudhuri quote : কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে কি, যাহা মনকে অভিভূত করিবার মত? আমরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ধারণা বিলাতের কল্পনায় করিতাম, একমাত্র সেখানকার দৃশ্যকে প্রাকৃতিক। সৌন্দর্য বলিয়া ধরিতাম, আমারও সেই মনােভাব ছিল। তাই ডি নদী ও মালভার্ন পাহাড়ের কথা মনে করিয়া যত আনন্দ পাইতাম, দেশের কথা মনে করিয়া তত আনন্দ পাইতাম না--অনন্ত মনকে বলিতাম না যে আনন্দ পাইতেছি। এই মনােবৃত্তির বশীভূত হইয়া “Banks and bracs o' bonie Doon
বিদেশের সৌন্দর্য সম্বন্ধে এই মনােবৃত্তির বশেই ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ভাবিলেও আমরা সুদূর কাশ্মীর, হিমালয়, পুরী বা ওয়ালটেয়ারের সমুদ্রতীরের কথা স্মরণ করিতাম। বাংলাদেশের কথা মনেই পড়িত না। তবু আমার মনের গভীরতম তলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা তীব্র অনুভূতি ছিল। বিরাট নদী, ঢেউখেলানাে ধানের ক্ষেত, দিকচক্রবাল পর্যন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখিলে মনে কোনও ভাব বা ধারণা আসিত না, শুধু শরীর-মন দিয়া উহার সঙ্গে মিশিয়া যাইতাম। কিন্তু এই দৈহিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গত অনুভূতির পিছনে কোন বিচার ছিল না। তাই আমার এই তন্ময়তাকে কখনও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি বলি নাই—অবশ্য অল্পবয়সে।

বড় হইয়া নিজেকে জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম, সত্যই কি বাংলাদেশের কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্য আছে? একদিন বিকালে বেড়াইবার সময়ে কিশােরগঞ্জ শহর হইতে রেল লাইন ধরিয়া মাইল। কয়েক উত্তর দিকে যাইবার পর একটা জলে ডােবা ধানক্ষেতের ওধারে একটি বাস্তুভিটা দেখিতে পাইলাম। মাঝখানে একটা পুকুর। তাহার উঁচু পাড়ের উপর ছয়-সাতটা আটচালা। উল্টাদিকে বাঁশের ঝাড়। স্থির নিস্তরঙ্গ জলে আটচালার স্পষ্ট ছায়ার সম্মুখে নীল আকাশ ও সন্ধ্যার রক্তিম মেঘের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। সমস্তটা কনস্টেবলের ছবির মত। তখনই বুঝিলাম, বাংলাদেশেরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে। উহার দিকে মুখ ফিরাইয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিতে হইবে। এই নূতন দৃষ্টি ফিল্মস্টারের রূপ হইতে চোখ ফিরাইয়া ঘরের মেয়ের রূপ দেখিবার মত।" style="width:100%;margin:20px 0;"/>