Home > Work > ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
1 " বারোটার সময় দাঁড়ালাম পেতলের ঘণ্টাটার পাশে। ওই ঘণ্টার শব্দ গুণে আমি ইস্কুলে যাই। কতো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে শুনেছি ওই ঘণ্টার দিগন্তের রহস্যবিভোর ধ্বনি। একজন দারোয়ান একটা বড় মুগুর দিয়ে দুটো-দুটো ক'রে ঘা দিলো। পৃথিবীতে বারোটা বাজলো, দুপুর হলো। সময়কে সেদিন আমরা বাজতে দেখলাম। "
― Humayun Azad , ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
2 " পালাতে পারলেই তো শুধু পারা যায় বেঁচে থাকতে। "
3 " আমাদের গাঁয়ের অধিকাংশ লোক গোলাপ দেখে নি, ঘ্রাণ চায় নি গোলাপের। তারা দেখে নি কোনো চোখ-ঝলসানো নাচ, কোনো দিন দেখার স্বপ্নও দেখে নি। কবিতা পড়ে নি তারা, কোনোদিন পড়ার কথা ভাবে নি। কখনো তাদের বুক থেকে চোখের জলের মতো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নি এ-কথা ভেবে যে এ-জীবনে তাদেরও একটি কবিতা পড়া হলো না। কেউ রাজা হ'তে চায় নি তারা। জরির পোশাক প'রে গোঁফ রেখে ধারালো তলোয়ার হাতে ক'রে ফিরতে চায় নি কেউ তারা। তারা চেয়েছে ভাত। স্বপ্ন দেখেছে মধুর মতো, তারার মতো, চাঁদের মতো, কড়িফুলের মতো ভাতের আর ভাতের আর ভাতের। জেগে উঠে দেখেছে সামনে প'ড়ে আছে শূন্য মাটির বাসন। "
4 " সবাই চ'লে গেছে, ঘোলা হয়ে আছে আমাদের পুবপুকুরের টলটলে জল। ভীষণ বিষণ্ন দেখায় পুকুরটিকে। ঘন ঘোলা পানি শব্দ করে না, কলকল করে না, নিথরভাবে প'ড়ে থাকে। তাতে ভাসতে থাকে ছিঁড়েফাড়া কচুরিপানা - এদিকে ভাসে ওদিকে ভাসে। মনে হয় কাঁদে। ঘোলা জলে কচুরিপানার ছবি গেঁথে আছে আমার চোখে। যখন আমি এ-শহরে, শহরকে আমার অনেক সময় ঘোলাজলের পুকুর ব'লেই মনে হয়, কাউকে ঘুরতে দেখি একা একা - বিষন্ন, মলিন উস্কোখুস্কো, তখনি মনে পড়ে মানুষ নামার পরে পুবপুকুরের ঘোলাজলে ভাসমান জীর্ণ কচুরিপানাগুলোকে। এমন কচুরিপানা-মানুষ দেখেছিলাম আমি একাত্তুরের সাতাশে মার্চে। পঁচিশে মার্চের আক্রমণ ও ছাব্বিশে মার্চের সান্ধ্য আইনের পরে সাতাশে মার্চে ঢাকা শহরের মানুষেরা বেরিয়ে পড়েছিলো রাস্তায় - হাঁটছিলো, ভয় পাচ্ছিলো, নিরুদ্দেশ পথ চলছিলো, ঠিক যেনো আমাদের পুকুরে মানুষ নামার পরে ঘোলা জলে এলোমেলো ভাসমান ছিন্নভিন্ন কচুরিপানার দল। "
5 " তুমি জানো না, কোনোদিন জানবে না, কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি শিশির দেখো নি, কুয়াশা দেখো নি, কচুরি ফুল দেখো নি। তুমি ধানের শীষ দেখেছো টেলিভিশনে, চিল দেখেছো ছবির বইতে। নালি বেয়ে ফোঁটাফোঁটা খেজুরের রস ঝরতে দেখো নি, পুকুরে দেখো নি মাছের লাফের দৃশ্য। তুমি জানো না কেমন লাগে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর কেমন লাগে একটি পাখির পেছনে ছুটে ছুটে সকালকে দুপুরের দিকে গড়িয়ে দিতে। আমি জানি; - না আমি জানতাম। "
6 " আমাদের শহরগুলো কোনোদিন শহর হবে না। হবে বস্তি। আমাদের গ্রামগুলো আর গ্রাম থাকবে না। হয়ে উঠবে বস্তি। "
7 " কতোদিন দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছি, গ'লে গেছি আমাদের গ্রামের আঠালো মাটির মতো। নকশি কাঁথাটি যাদু-চাদরের মতো জড়িয়ে রেখেছে আমাকে। সন্ধ্যায় জেগে উঠে মনে হয়েছে এইমাত্র ভোর হলো। মুখ ধুতে হবে, ইস্কুলে যেতে হবে। মা বলতো, 'এখন বিআইন নারে, এখন সাঁইজের বেলা।' তখন মনে হতো ঘুম ভাঙলেই তো ভোর বেলা, ঘুম যখনি ভাঙুক। অমন ভোর আর কি ফিরে পাবো কোনো দিন! "