Home > Work > আপিলা-চাপিলা
1 " ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকরা স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিম বাংলার সমস্যার প্রধানত যে ধরনের বিশ্লেষণ করেছেন, যা পরে পড়েছি, তা একটি বিরাট অপূর্ণতার শিকার। পঞ্জাবের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, ওরা কেমন নিজেদের উদ্যোগে ঝটপট দেশভাগের সমস্যা পেরিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ জীবনে উঠে আসতে পেরেছে, বাঙালিরা পারেনি কারণ তারা উদ্যমহীন, পরের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাতে তাদের জুড়ি নেই। এই স্বভাবনিন্দুকরা সময়ের পটভুমিকাটুকু ভুলে থাকতে চান। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধজনিত সামাজিক-আর্থিক চাপ বাঙালি অস্তিত্বকে, সেই সঙ্গে অস্তিত্বচেতনাকেও নড়বড়ে করে দিয়েছিল, যে সংকট পঞ্জাবকে ছুঁতে পারেনি। উদ্বাস্তুদের জন্য পঞ্জাবে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে যে-পরিমাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার সিকি পরিমাণও বাঙালি শরনার্থীদের ভাগ্যে জোটেনি। মহাযুদ্ধ থেকে পঞ্জাবের আখেরে লাভই হয়েছেঃ ফৌজে-যোগ-দেওয়া পঞ্জাবকুল তাঁদের বিত্তের সম্ভার বাড়াতে পেরেছিলেন, বাঙালিরা যা আদৌ পারেননি। "
― Ashok Mitra , আপিলা-চাপিলা
2 " উনবিংশ শতকের বাঙালি উজ্জীবন নিয়ে অনেক চর্চা ও গবেষণা হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ ইত্যাদির নায়কত্বে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে তার পরের অন্তত তিরিশ বছর বাঙালি জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল, তা নিয়ে তন্নিষ্ঠ আলোচনা এখনও হয়নি। 'নবান্ন' নাটক সম্বন্ধে বহু কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ওই নাটক তো সবে সূচনা: নাটক ছাড়িয়ে লোকনৃত্য, লোকনৃত্য ছাড়িয়ে লোকগাথা, যাত্রা মৃৎশিল্প, সাহিত্য, কাব্য, সংগীত, চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য, এমনকি সুনীল জানার মতো শিল্পীর ক্যামেরা নিয়ে সাধনা, তাপস সেনের আলো নিয়ে, খালেদ চৌধুরী মঞ্চসজ্জা নিয়ে। সবাই মানুন না-মানুন, এই মস্ত সাংস্কৃতিক উতরোলের উৎস দুর্ভিক্ষ-উত্তর সেই সমাজজিজ্ঞাসা থেকে। "
3 " ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাস, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে কমিউনিস্ট পার্টি কেরলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম, কাতারে-কাতারে দেশ-বিদেশ থেকে সাংবাদিকরা নতুন দিল্লি-তিরুবনন্তপুরমে জড়ো হয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী নাম্বুদিরিপাদকে চাক্ষুষ দেখতে, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। নতুন দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক চলছে, এক বিদেশী সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে ই এম এস-কে প্রায়-নির্বোধ প্রশ্ন ছুঁড়লেনঃ ‘মহাশয় আপনার বাক্-জড়তা লক্ষ্য করছি, আপনি কি সবসময়ই তোতলান?’ ই এম এস-এর সহাস্য ক্ষিপ্র জবাবঃ ‘আজ্ঞে না। আমি তোতলাই একমাত্র যখন কথা বলি। "
4 " ঢাকাতে বিদেশবিভুঁয়ের দল খেলতে এলে বরাবরই একটু বিপাকে পড়তাে। আরও দু-তিন বছর পূর্বেকার কাহিনী: বিলেত থেকে আর্সেনাল-উলভারহ্যাম্পটন ইত্যাদি দুর্ধর্ষ ক্লাব থেকে বাছাই করে গঠিত ইসলিটন কোরিন্থিয়ান্স নামে এক ফুটবল দল ভারতবিহারে এল। তারা পেশােয়ার থেকে ত্রিবান্দ্রম, করাচি থেকে কলকাতা-মাদ্রাজ সব মিলিয়ে বিভিন্ন শহরে গােটা পঁচিশ খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। ভারতবর্ষের অন্য সবকটি খেলায় তারা অপরাজিত, একমাত্র ঢাকা ফুটবল অ্যাসােসিয়েশনের কাছে, কী আজব ব্যাপার, তারাও এক গােলে হেরে গেল। গােলটি করেছিলেন উয়াড়ি ক্লাবের পাখি সেন, যিনি কলকাতায় রেলের টিমে খেলতেন। আই এফ এ দলে তার জায়গা হতাে না, কিন্তু স্বস্থান ঢাকায় বিজয়ী বীর। মনে আছে, পরের দিন ঢাকার সমস্ত স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল বিজয় উৎসবের আবেগে। "
5 " অবশ্য সব কিছু ছাপিয়ে মন্বন্তরের বিভীষিকা! বাংলাদেশে সে বছর ফসলের ঘাটতি তেমন ছিল না। কিন্তু ফসলের একটা বড় অংশ মহান বিদেশী সরকার অন্যত্র পাচার করে দিয়েছিলেন। তার উপর জেলা থেকে ও-জেলায়, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, খাদ্যশস্য যাতে অবাধে বাহিত হতে না পারে, সেজন্য প্রতিটি জেলায় কাতারে কাতারে সব ধরনের নৌকো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। পরাধীন দেশ, সেই সঙ্গে প্রভুদের মনে জাপানি আতঙ্ক। জাপানিরা এসে পাছে ফসলের দখল নেয়, তাই শসা বাজেয়াপ্ত করাে, নৌকো ডুবিয়ে দাও বা বাজেয়াপ্ত করো। সরকার যে বীভৎস কুকাজ আরম্ভ করলেন, সেটা সম্পন্ন করলেন জোতদার-মহাজন সম্প্রদায়। ইতিপূর্বে মজুতদার কথাটির সঙ্গে সাধারণের পরিচয় হয়নি, এবার হলাে। সর্বত্র আতঙ্ক। যাঁদের বিত্তের সম্পদের জোগান ছিল, জীবিকাগত ভিত্তি ছিল, তার কোনওক্রমে খেয়ে-পরে বাঁচলেন। অন্যদের ক্ষেত্রে খাদ্যের অনটন, পরিচ্ছদের অনটন। শহরে-গ্রামে ভয়, যে ভয়ের বাস্তব ভিত্তি ছিল। চালের দাম হু হু করে চড়তে শুরু করলাে তেতাল্লিশ সালের গােড়া থেকে, কাপড়ের দামও। ক্রমশ বাড়তে লাগলাে নিরন্নের হাহাকার, গ্রাম ছাপিয়ে শহরে। "
6 " ত্রিবান্দ্রম থেকে জনৈক বন্ধু, খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যও ছিলেন, অগস্ট মাসে আমাকে একটি আবেদনের খসড়া পাঠালেন, আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে। তিনি সমস্ত দিক বিবেচনা করে অবিলম্বে জরুরি অবস্থার ঘােষণা যেন অনুগ্রহ করে প্রত্যাহার করে নেন। বন্ধুটির অনুরােধ, আমি নিজে যেন সই করি, এবং সত্যজিৎ রায়ের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে যেন সাহায্য করি। টেলিফোন করে এক সকালে বিশপ লেফ্রয় রােডের ফ্ল্যাটে গেলাম, ওঁর যা চিরাচরিত নিয়ম, সত্যজিৎবাবু নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন, সাদরে বসালেন, আগমনের কারণ খুলে বললাম, খসড়াটি ওঁকে পড়তে দিলাম। সেদিন ওঁর ব্যবহার ও আচরণ অতি চমৎকার লেগেছিল। পাঠান্তে আমার দিকে তাকিয়ে সত্যজিৎবাবু স্পষ্ট বললেন: ‘মশাই, আমার যে-বৃত্তি তাতে সরকারের উপর একান্ত নির্ভর করতে হয়, কাঁচা ফিল্মের জন্য তদ্বির করতে হয়, সেন্সরে ছাড় পাওয়ার জন্যও। সিনেমা হলের মালিকরাও সবাই-ই সরকারের বশংবদ। এই অবস্থায় এক কাজ করুন, আপনি রবিশঙ্কর বা আলি আকবরের কাছ থেকে একটা সই জোগাড় করে নিয়ে আসুন, তা হলে আমিও দ্বিধাহীন চিত্তে স্বাক্ষর জুড়ে দিতে পারি।’ এই খোলামেলা কথা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, কারণ ওই সময়েই একজন-দু’জন কলকাতাস্থ ভদ্রলােকের কথা জানতাম, যাঁরা পুরােপুরি দু নৌকোর কাণ্ডারী, মুখে বিপ্লবী বাণী কপচাতেন, অথচ সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে রাশিয়া-আমেরিকাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জরুরি অবস্থা ঘােষণা ও লক্ষ-লক্ষ নাগরিককে সরকারের তরফ থেকে জেলে পােরার পরেও। "
7 " হঠাৎ কলকাতার সাহিত্যিক-সাংবাদিক মহলে হুলস্থুল, উনিশ শাে চৌষট্টি সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস, পূর্ব পাকিস্তানে ফের দাঙ্গা, ওখানকার ঘটনাবলীর যথাযােগ্য জবাব দিতে আনন্দবাজার পত্রিকা কলকাতার বুকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধাবার জন্য প্রতিদিন সব ক'টি পাতা উজাড় করে বিষ ঢালছে। কর্তৃপক্ষের না কি ইচ্ছা, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডেও অনুরূপ নীতি গ্রহণ করা হােক। কার্যত সমরবাবুই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন, যদিও স্বত্ত্বাধিকারীদের একজনের নাম সম্পাদক হিশেবে মুদ্রিত হয়। একদিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রচুর কথা কাটাকাটি, আধঘণ্টা কাটতে না কাটতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে সমরবাবু সুতারকিন স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে ধর্মতলার মােড়ে বালিগঞ্জের ট্রামে চাপলেন, আর কোনওদিন ফিরে গেলেন না। 'স্বাধীন সাহিত্য সংঘ’ নামে যে কবি-সাহিত্যিক- সাংবাদিকের দল কমিউনিস্ট-বিরােধী জিগির তুলছিলেন, তাঁরা একটু বিব্রত হলেন, পরিচালকপক্ষ ও সম্পাদকের পারস্পরিক বাকস্বাধীনতার লড়াইতে তাঁদের তাে কর্তাব্যক্তিদের স্বাধীনতা সমর্থন না-করে উপায় ছিল না! "
8 " দ্বিতীয় সমস্যাটি শুধু পশ্চিম বঙ্গ নয়, গােটা পূর্ব ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী একটি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। ১৯৫৬ সাল, টি. টি. কৃষ্ণমাচারী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, তিনি নিজেও তামিলনাড়ুতে বড়াে গােছের শিল্পপতি, হিশেব কষলেন, শিল্পক্ষেত্রে পূর্ব ভারতের আপেক্ষিক অগ্রগতি রােধ করতে হলে, সেই সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পের প্রসার ঘটাতে গেলে, নিয়মনীতির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ কৌশল খাটাবার সমূহ প্রয়ােজন। বাংলা-বিহার অঞ্চলে খনিজ পদার্থের প্রাচুর্য, লােহা আছে, কয়লাও আছে, উভয় খনিজ উত্তোলন করে কয়লা দিয়ে লােহা গালিয়ে শস্তায় ইম্পাত তৈরি সম্ভব, সেই ইস্পাত পিটিয়ে কলকজা-যন্ত্রপাতি তৈরি করাও, যার প্রসাদে পূর্ব ভারত জুড়ে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়, ব্যাপক এঞ্জিনিয়ারিং শিল্প একদা গড়ে উঠেছিল, যার নির্ভরে, ইংরেজ আমলে, এবং স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছর, এই রাজ্যে শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সম্ভব হয়েছে, অন্যান্য অঞ্চল তুলনায় ধুঁকেছে। টি. টি. কে. মাথা খাটিয়ে কৌশল উদ্ভাবন করলেন, সারা দেশে লােহা ও ইস্পাতের পরিবহন মাশুলের হার সমান করে দেওয়া হলাে, যার ফলে সারা দেশে লােহা ও ইস্পাতের দাম এক হয়ে গেল। কয়লার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি হলাে আরও মজাদার : যত বেশি দূর কয়লা বহন করে নিয়ে যাওয়া হবে, মাইল প্রতি পরিবহন মাশুল তত কম পড়বে। অর্থাৎ রানীগঞ্জ থেকে দুর্গাপুরে কয়লা টন প্রতি যে দামে বিকোবে, ত্রিচিনাপল্লীতে বা পুনেতে বা জলন্ধরে তার চেয়ে কম দামে। কেন্দ্রের এই মারাত্মক সিদ্ধান্তের পরিণামে নিছক এঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের ক্ষেত্রেই নয়, সব শিল্পের ক্ষেত্রেই, পশ্চিম বাংলা খরচ-খরচার ব্যাপারে যে-আপেক্ষিক সুবিধা ভােগ করে আসছিল, তা চকিতে উবে গেল। "
9 " এই বিশেষ মুহূর্তে শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশেম কর্তৃক অখণ্ড বঙ্গদেশের যুগ্ম প্রস্তাব, যার সঙ্গে হাসান শহিদ সােহরাবর্দিও খানিক বাদে নিজেকে যুক্ত করলেন। অকুলপাথারে যেন পরিত্রাণের ইঙ্গিত পেলাম। বঙ্গভূমিস্থ প্রায় প্রতিটি বামপন্থী দল এই প্রস্তাবের পক্ষে; কিন্তু হলে কী হবে, কংগ্রেসের অন্য দিকে ঝুঁকে-পড়া। এবং কংগ্রেসের নতুন মিত্র হিন্দু মহাসভা। শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় উঠে-পড়ে লাগলেন, বাংলাদেশ যাতে ভাগ হয়ে যায় এবং হিন্দুপ্রধান পশ্চিম প্রান্তের জেলাগুলি যাতে ভারতের অঙ্গীভূত হয়, পুবের জেলাগুলির মানুষজন পড়ে মরুক গে। শ্যামাপ্রসাদের মতের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানালাে কংগ্রেস। হিন্দু মহাসভার অবিসংবাদী নেতা আশুতােষ-তনয় তাঁর মত প্রচারে ঢাকায় বক্তৃতা দিতে এলে অ-মুসলমান ছাত্ৰকুল দল বেঁধে প্রতিবাদে সামিল হলাম। করােনেশন পার্কের সন্নিকটে আমাদের ঠেকাতে বেপরােয়া লাঠির বাড়ি পুলিশের। কী আশ্চর্য মহাযােগ: হিন্দু মহাসভার নেতাকে ছাত্ররােষের হাত থেকে বাঁচাতে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভার পুলিশ লাঠিপেটা! কয়েকজনের মাথা ফাটল, হাত ভাঙলো। "
10 " ফজলুল হক সাহেব ওই সময়েই কংগ্রেস দলের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে তা গড়তে দেওয়া হলাে না। বাধ্য হয়ে মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গ প্রদেশের সরকার গড়লেন তিনি। জ্ঞানােন্মেষের পর আমি বহুবার ভেবেছি, শরৎ বসু মশাইকে যদি ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে হাত মেলাতে কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিতেন, তা হলে হয়তাে গােটা ভারতবর্ষেই তথাকথিত সাম্প্রদায়িক সমস্যা অন্য চেহারা নিত। যদি বছর পাঁচেক হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা মিলে-মিশে প্রাদেশিক প্রশাসন চালনা করতেন, জনমুখী, বিশেষ করে প্রজাকুলের স্বার্থে, বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, ভেল্কিবাজি ঘটতো। হক সাহেব নিজের উদ্যোগে জমিদার ও মহাজনদের ক্ষমতা খর্ব করতে যেমন সফল হয়েছিলেন, তেমনই হতে পারতাে কংগ্রেস-কৃষক প্রজা দলের সম্মিলিত উদ্যোগেও। নিশ্চয়ই তার প্রভাব গােট ভারতবর্ষের রাজনীতির উপর ছড়িয়ে পড়তে এবং সম্ভবত বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক অভ্যুদয় কুড়ি-পঁচিশ বছর এগিয়ে আসতাে। ফলে তাঁদের হীনম্মন্যতাবােধ দ্রুত হ্রাস পেত, অন্য দিকে উপর তলার হিন্দুদের ছড়ি-ঘােরানাে মানসিকতা ক্রমশ দমিত হতাে। এটা তাে না মেনে উপায় নেই, আমাদের মতাে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখনও পর্যন্ত সমাজচেতনার অগ্রদূত হিশেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে সুখবােধ করেন। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তদের মধ্যে যদি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সৌম্য সংঘটিত হতাে, সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির আশঙ্কা অঙ্কের নিরিখে অনেকটাই নির্বাপিত হওয়ার সভাবনা ছিল। "
11 " অ-মুসলমান ছাত্রদের কাছে একটা মস্ত আবিষ্কার : মুসলমান ছাত্রনেতারা কোনও সংকোচ বা অবদমনে ভুগতেন না, মনের কথা দুর্দান্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতেন। খাজা নাজিমুদ্দিনকে লক্ষ্য করে যেমন গাল পাড়া, অন্যদের সম্পর্কেও সমান অকুতােভয়। নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিন-চার সপ্তাহের জন্য বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়ংকর বস্ত্ৰসমস্যা; মহিলাদের পরিধেয়ের পর্যন্ত আকীর্ণ অভাব। ছাত্রদল ক্ষিপ্ত, লম্বা মিছিল করে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসস্থান অভিমুখে ধাওয়া। ছাত্রদের মেজাজ দেখে রক্ষীবাহিনী ভীত, এখানে-ওখানে নিজেদের লুকোলাে। আমরা সােজা মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকখানায়। নুরুল আমিন প্রায় ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছেন, দয়া ভিক্ষা করার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় নতজানু। হঠাৎ শুনি ছাত্রদের মধ্য থেকে কারও কর্কশ ক্রোধোক্তি: ‘আমাদের মায়েরা-বােনেরা কাপড় পাচ্ছে না, আর তুই হতভাগা নিজের বিবির জন্য বারাে সুটকেস ভরে শিফন শাড়ি এনেছিস বিদেশ থেকে, তােকে কোতল করবাে’। "
12 " এরই মধ্যে আমরা শিশুরা কী করে যেন শুনতে পেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবার এক প্রতিভাবান ছাত্র-অনিল দাস—ঢাকা জেলে বন্দী হয়ে আছেন। আমাদের বাড়ির আর বাইরের পরিধির বাইরেও, তাঁর পৃথিবীর ভয়ংকরতা আমাদের অনুমানের অনেক দূরে। একদিন সারা শহর জুড়ে আলােড়ন, পাড়াতেও শােরগােল। অনিল দাস তাঁর কারাকক্ষে মাঝে-মাঝেই বেপরােয়া চিকার করে উঠতেন বন্দে মাতরম্। যতবার চেঁচাতেন, ততবার জেলের প্রহরী তাঁকে চাবুক দিয়ে, লাঠি দিয়ে, মুষ্ট্যাঘাত-সহ মারতেন। সেই রকমই নাকি নির্দেশ ছিল জেলার সাহেবের। এমনই এক রাতে অনিল দাস সামগানের মতাে অবিরত, অপ্রতিহত চেঁচিয়ে গেছেন বন্দে মাতরম্, প্রতি উচ্চারণের সঙ্গে বর্ষিত হয়েছে কশাঘাত। উচ্চারণ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হলেও তবু তা থামতে চায়নি। একটা সময়ে কিন্তু থেমে গেল, প্রহারের উৎপীড়নে অনিল দাসের প্রাণবায়ু নিঃসৃত। আমার অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের মানচিত্রে প্রথম শহিদ হিসেবে অনিল দাসের নাম মুদ্রাঙ্কিত। সারা শহর উতরােল। কিন্তু পরাধীন দেশ, মন্থর সময়, ক্ষণিক বাদে সেই আবেগক্রোধবিলাপের চিৎকারও স্তিমিত হয়ে গেল। পরে বড়াে হয়ে অন্য অভিজ্ঞান: স্বাধীন ভারতে কলকাতার রাস্তায় ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে যে-শােভাযাত্রা বেরিয়েছিল, কংগ্রেস সরকারের ফৌজ তার উপর গুলি চালালে ঘটনাস্থলে যে-চারজন মহিলার মৃত্যু ঘটেছিল, তাঁদের অন্যতম লতিকা সেন, অনিল দাসেরই সহােদরা। ওই পরিবারে শহিদ হওয়া বােধহয় অমােঘ বিধান ছিল। "
13 " শুধু আমাদের আর্মেনিটোলা পাড়াতেই নয়, গােটা শহর জুড়ে একই কাহিনী। যে কোনও পাড়ার আমরা যে কোনও গলি-উপগলি দেখিয়ে গর্বভরে বলতে পারতাম, গলির প্রথম বাড়ি থেকে কেউ বিলিতি কাপড়ের বা বিলিতি মদের দোকানে পিকেটিং করে জেলের ঘানি টানছে; দ্বিতীয় বাড়ি থেকে কেউ পুলিশ খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে আন্দামানে পায়ে বেড়ি পরে দিনাতিপাত করছেন; তৃতীয় বাড়ির প্রথম পুত্রসন্তান রাজনৈতিক কারণে বিনাবিচারে বন্দী হয়ে আছেন দমদম কি মেদিনীপুর জেলে। ওই বাড়ির কন্যাসন্তানটি আবার লীলা রায়ের শ্রীসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত। তিনি হয়তাে দাদা-দিদিদের মধ্যে দূতীর কাজ করতেন, কেমন করে পিস্তল পাচার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান, সেই থেকে আমাদের ঢাকা জেলেই আটক হয়ে আছেন। বহুযুগ বাদে, আমার যুবাবয়সে, জীবনানন্দ দাশ আমাকে জানিয়েছিলেন, এমন এক রাজবন্দিনীর বৃত্তান্ত খবর কাগজে পড়েছিলেন: রাজশাহী জেলে কারারুদ্ধ, নাম বনলতা সেন। "
14 " জীবনানন্দের তৎকালীন বিষণ্ণতার ঈষৎ আলাদা এক আজব কারণ ছিল। অর্থাভাব, দিলীপ গুপ্ত সিগনেট প্রেস থেকে প্রচুর আগ্রহভরে ‘বনলতা সেন’-এর নতুন সংস্করণ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন, বেশ কিছু টাকা জীবনানন্দকে আগাম দিয়েছেন, কলেবর বৃদ্ধির প্রয়ােজনে ‘পূৰ্ব্বাশা’ থেকে পূর্ব-প্রকাশিত ‘মহাপৃথিবী’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত অনেকগুলি কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর সিগনেট সংস্করণে জীবনানন্দ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তা নিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে সামান্য মন-কষাকষি, কিন্তু তা ছাপিয়ে আরও বড়াে বিরক্তি-বিষন্নতা: দিলীপ গুপ্ত সত্যজিৎ রায়ের উপর চড়াও হয়ে তাঁকে দিয়ে ‘বনলতা সেন’-এর সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদ আঁকিয়েছেন, যা জীবনানন্দের আদৌ পছন্দ হয়নি, কিন্তু তা মুখ ফুটে দিলীপ গুপ্তকে বলতে পারছেন না, শুধু আমাদের কয়েকজনকে সন্তর্পণে কাছে ডেকে এনে নালিশ জানাচ্ছেন: ‘এ কোন বনলতা সেন, এটা তাে কৈকেয়ী বুড়ি!’ ‘বনলতা সেন'-এর কবিতাভবন সংস্করণের প্রচ্ছদের ছবি এঁকেছিলেন শম্ভু সাহা, ভারি মায়ালু দেখতে ছিল সেই প্রচ্ছদ, যার শােক জীবনানন্দ ভুলতে পারছিলেন না। "
15 " কাসেম খলিফার শুভ্র শ্মশ্রু কোমর গড়িয়ে নেমে গেছে, শান্ত সমাহিত চেহারা। চোখে ভালো দেখতে পেতেন না, শার্টের মাপ নিতে প্রায়ই গোলমাল করতেন। ঝুল কিংবা যাকে বলা হত পুট, তার হিশেবে প্রায়ই গোলমাল করে বসতেন। হাতা বড় হলে বলতেন, ‘খোকামিয়াঁ, ওটাই ফ্যাচাং’। হাতা ছোট হলেও বলতেন একই কথা। "
16 " নাগপুরের অর্ধেন্দুভূষণ বর্ধন, এখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, মঞ্চে প্রধান অভ্যর্থনাজ্ঞাপকের ভুমিকায়। যুগােশ্লাভিয়া থেকে আগত প্রতিনিধিরা মঞ্চে সদ্য সমাগত, বর্ধন স্লোগান দিচ্ছেন, ‘যুগােস্লাভ প্রতিনিধিবৃন্দ জিন্দাবাদ!’ হঠাৎ নজরে এলে মঞ্চে উপবিষ্টা গীতা মুখোপাধ্যায় পাশে-বসে-থাকা সুখেন্দু মজুমদারকে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছেন, সেই সঙ্গে ফিস ফিস অনুজ্ঞা: ‘যাও, বর্ধনকে যােগ করতে বলল, “কমরেড টিটো জিন্দাবাদ”।’ইতিহাসের এমনই বিচিত্র রসিকতা, মাত্র কয়েক মাস গত হতেই কমরেড টিটো আর কমরেড রইলেন না, যুগােস্লাভ রাষ্ট্র কমিনটার্ন থেকে, নাকি কমিনফর্ম থেকে, বিতাড়িত। দুই বাংলা জুড়ে বামপন্থীরা ভ্যাবাচ্যাকা, ঘরে-ঘরে কয়েক হাজার সদ্য-জন্ম-নেওয়া শিশু, যাদের আদর করে টিটো নাম দেওয়া হয়েছিল, তারা রাতারাতি টুটু বনে গেল। "